একটি উদ্যোগ, একটু চেষ্টা, এনে দিবে স্বচ্ছলতা, দেশে আসবে স্বনির্ভরতা।

সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ

জন্মঃ ১৯ জানুয়ারি, ১৯৩৬; ডাক নামঃ কমল (পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে জিয়া ছিলেন দ্বিতীয়); পিতাঃ মনসুর রহমান (তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করে কলকাতায় আলীপুর টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে চাকুরিতে যোগ দেন।); মাতাঃ জাহানারা খাতুন (তিনি রেডিও পাকিস্তানের করাচি কেন্দ্রের তালিকাভুক্ত নজরুলসংগীত শিল্পী ছিলেন); পিতামহঃ মৌলভি কামাল উদ্দিন; মাতামহঃ আবুল কাশেম (তার জন্ম জলপাইগুড়ির বিখ্যাত টি ফ্যামিলিতে। ব্রিটেনের রাণী ভিক্টোরিয়া তাদের ফ্যামিলিকে এই সম্মাননায় ভূষিত করেন।) অন্যান্য ভাইঃ রেজাউর রহমান বকুল (তিনি এক সময় পাকিস্তান নৌ বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ নিয়ে অবাঙালি সহকর্মীদের সঙ্গে বাদানুবাদের জের ধরে তিনি নৌ বাহিনীর চাকুরি থেকে ইস্তফা দেন। এরপর লন্ডনে তড়িৎ প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশুনা করেন এবং আইসিও সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন।), মিজানুর রহমান ববি, খলিলুর রহমান বাবুল এবং আহমেদ কামাল বিলু (তিনি প্রতিষ্ঠাকালে বিএনপির সাথে জড়িত ছিলেন)।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর জিয়ার পিতা চাকুরির কারণে পরিবারবর্গ নিয়ে করাচি চলে যান। অল্প বয়সে ১৯৫০ সালে জিয়ার মা মারা যান, আর ৬৮ বছর বয়সে ১৯৭০ সালে জিয়ার বাবা হৃদরোগে মারা যান।

পূর্বপুরুষের বাসস্থানঃ বগুড়া জেলার বাগবাড়ি গ্রাম। তবে প্রকৃতপক্ষে মূল বসতি ছিল একই জেলার গাবতলি উপজেলার মহিষাবান গ্রাম। পূর্বপুরুষের ঠিকানা নিয়ে এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল দুটি কারণে। জিয়ার ভাইদের অনেকেই তাদের পিতামহী মিসিরুন্নেসার পিত্রালয় বাগবাড়িতে বড় হন। অপর কারণ, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর জিয়া বাগবাড়িতে গেলে গণমাধ্যমে প্রচারিত হত তিনি তার গ্রামের বাড়িতে গেছেন।

শিক্ষাজীবনঃ তার শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি কলকাতার সবচেয়ে পুরনো ডেভিড হেয়ার স্কুলে। পিতামাতার সঙ্গে করাচি চলে যাওয়ার কারণে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র জিয়া এই স্কুল ছেড়ে যান। করাচি গিয়ে ১লা জুলাই ১৯৪৮ সালে একাডেমি স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে ঐ স্কুলের নতুন নামকরণ হয় ‘তায়েব আলি আল্ভি একাডেমি’। ঐ স্কুল থেকে ১৯৫২ সালে ম্যাট্টিকুলেশন পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন। জিয়া ছিলেন স্কুলের হকি দলের একজন চৌকষ খেলোয়াড়। স্কুলের পড়াশেষে জিয়া ভর্তি হন করাচির ডি জে সাইন্স কলেজে। তার উদ্দেশ্য ছিল বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করা। কিন্তু সে বছরই তিনি কাকুলে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। এ সময়ে জিয়া নিয়মিতিভাবেই পাকিস্তান জাতীয় সংসদের অধিবেশনও দেখতে যেতেন। এ ক্ষেত্রে তার জন্য পাসের ব্যবস্থা করে দিতেন তার আত্মীয়, যশোর থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম।

সামরিক জীবনঃ ক্লাসের প্রথম ১০ শতাংশের একজন হিসেবে ১৯৫৫ সালে জিয়া পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে গ্রাজুয়েশন এবং একই বছরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে তাকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি করা হয়। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি কাজ করেছেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দা পরিদপ্তরে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় একজন কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের খেমকারান সেক্টরে লড়াই করেন জিয়া। এই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তার কোম্পানিই সর্বোচ্চসংখ্যক পদকে ভূষিত হয়। জিয়া পিএমএতে প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৬৬ সালে। পিএমএ থেকে তাকে পাকিস্তানের কোয়েটায় সেনাবাহিনীর স্টাফ কলেজে একটি কমান্ড কোর্সে যোগ দিতে পাঠানো হয়। ১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে যোগ দেন। এরপর একপর্যায়ে পশ্চিম জার্মানিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে জার্মানি থেকে দেশে ফিরে আসার পর জিয়াকে (তখন তিনি মেজর) চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে বদলি করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জিয়াই সর্বপ্রথম ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতে বিদ্রোহ করেন। এর মাধ্যমে প্রকৃত পক্ষে চট্টগ্রামে তার অধীনস্থ সৈন্যদেরকে নিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু করেন তিনি। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তিনি অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক এবং পরে জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে দুঃসাহসী সেনানায়কের একটা আলাদা পরিচয় অর্জন করেন জিয়া এবং বীর উত্তম খেতাব লাভ করেন। সম্প্রতি একাত্তর সালের ২৫শে মার্চের ঘটনাবলি নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল সে ব্যাপারে সমশের মবিন চৌধুরি বীর বিক্রম জানানঃ ‘সত্যি বলতে কি, ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে দেওয়া মেজর জিয়ার সেই বিখ্যাত স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে নিজের ভাষ্য দিতে গিয়ে প্রত্যেকেই আসল সত্য থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। এই সাহসি লোকটির অধীনে চট্টগ্রামে লড়াই করাকালে স্মস্র স্বকর্ণে তা শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, মেজর জিয়ার নির্দেশে ২৮ মার্চ সারাদিন সেই কেন্দ্র থেকেই আমাকে তার ঐতিহাসিক ঘোষণাটি বারবার প্রচার করতে হয়েছিল। আমার সঙ্গে ছিলেন সুবিদ আলি ভুঁইয়া। ১১ এপ্রিল কালুরঘাট ব্রিজের ঐতিহাসিক লড়াইয়ে আহত হয়ে আমি পাক বাহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার পর তারা তা ছিড়ে ফেলার আগ পর্যন্ত মূল কপিটি আমার কাছে ছিল।’

বৈবাহিক জীবন ও পরিবারঃ সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে দিনাজপুরে কর্মরত থাকা অবস্থায় ৫ আগস্ট ১৯৬০ জিয়া বিয়ে করেন। কনে খালেদা খানম ছিলেন অল্পবয়সি, সবেমাত্র ম্যাট্টিক পাস করেছেন। বিয়ের ব্যাপারে মূল ভূমিকা পালন করেন জিয়ার মাতামহ মকবুল আহমদ। জিয়ার পিতামহী ও খালেদার মাতামহী ছিলেন পরস্পরের খালাতো বোন। প্রচলিত নিয়মানুযায়ী দিনাজপুরের মুদিপাড়ায় খালেদার পৈত্রিক বাসভবনে এ বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল সাদামাটা। জিয়ার কয়েকজন সহকর্মি উপস্থিত ছিলেন বিয়েতে। বছরখানেক পর বিয়ের আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয় হোটেল শাহবাগে। চাকরির কারণেই জিয়া ও খালেদা জিয়ার দাম্পত্য জীবনের প্রথম চার বছর কাটে দিনাজপুরে। জিয়া এবং বেগম খালেদা জিয়ার দুই ছেলে। বড় ছেলে তারেক রহমান (পিনু)-এর জন্ম ২০ নভেম্বর ১৯৬৫। তিনি বর্তমানে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান (কোকো)-এর জন্ম ১২ আগস্ট ১৯৭০। ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধে জিয়া পরিবারঃ পরিবারকে ফেলে রেখে জিয়া স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে তার স্ত্রী আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। তখন চট্টগ্রামে যে বাড়িতে বেগম জিয়া ও তার দুই ছেলে থাকতেন তার পাশ দিয়ে জিয়া একদিন তার সেনাদল নিয়ে যাওয়ার সময় লেফট্যানেন্ট সমশের মবিন তার কাছে জানতে চান, তিনি পরিবারকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চান কি না। জিয়া উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার অধীনে থাকা ৩০০ সৈনিক যদি তাদের পরিবার ত্যাগ করে আসতে পারে, তাহলে আমি আমার পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি না।’ তখন এই বাড়ির তৃতীয় তলায় সপরিবারে থাকতেন লেফট্যানেন্ট এওয়াইএম মাহফুজুর রহমান (জিয়া হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত)। জিয়ার অবর্তমানে যুদ্ধের সময় বড় বোন খুরশিদ জাহান হকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বেগম জিয়া চট্টগ্রাম থেকে লঞ্চে করে ১৬ মে ১৯৭১ নারায়ণগঞ্জে পৌঁছান। সঙ্গে ছিল দুই ছেলে ও লেফট্যানেন্ট মাহফুজের স্ত্রী। নারায়ণগঞ্জ থেকে তাকে ঢাকা নিয়ে আসা হয়। তবে বেশিদিন তিনি পালিয়ে থাকতে পারেন নি। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় যশ্রয়ের চেষ্টাকালে পাক বাহিনী তার সন্ধান পেয়ে যায় এবং ২ জুলাই এসকে আব্দুল্লাহর সিদ্ধেশ্বরির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি সামরিক হেফাজতে বন্দীজীবন কাটিয়েছেন।
সেই সময় ঢাকায় দায়িত্ব পালনরত পাকিস্তানি সামরিক অফিসার মেজর জেনারেল জামশেদকে ২১ আগস্ট ১৯৭১ একটি চিঠি লিখেন জিয়া। পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কর্মরত থাকাকালে জেনারেল জামশেদ তার অধিনায়ক ছিলেন। জামশেদকে তিনি লিখেন, ‘Dear General Jamshed, My wife Khaleda is under your custody. If you do not treat her with respect, I would kill you someday. Major Zia.’
পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের দিন জিয়া ছিলেন সিলেটের সমশেরনগরে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নির্দেশে ঢাকা থেকে বেগম জিয়া ও তার ছেলেদেরকে সমশেরনগরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিমানবন্দরে তাকে নিতে আসেন মেজর চৌধুরি খালেকুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন অলি আহমদ। তাদেরকে স্থানীয় একটি রেস্টহাউজে রাখা হয়। কত তারিখে বেগম জিয়া সমশেরনগরে যান এবং কতদিন সেখানে তিনি অবস্থান করেন তা স্পষ্ট নয়। বেগম খালেদা জিয়া দিন তারিখের কথা মনে করতে না পারলেও ঘটনাটি তার স্মরণে আছে। মেজর জেনারেল আইনুদ্দিন বীর প্রতীক বলেন, ’১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ তিনি কুমিল্লা সার্কিট হাউজে জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেন।’ এই উক্তি সঠিক বলে ধরে নিলে বোঝা যায় সমশেরনগরে বেগম জিয়ার অবস্থান ছিল সংক্ষিপ্ত।
স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে জিয়াঃ স্বাধীনতার পরপরই কুমিল্লা সেনানিবাসে ৪৪ পদাতিক ডিভিশনের দায়িত্ব গ্রহণের পর সৈনিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে জিয়া নিজেকে নিয়োজিত করেন। সৈনিকদের পরিবারের সদস্যদের শিক্ষার জন্য নৈশ বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্যে তিনি সিনিয়র আমলা মোকাম্মেল হকের সহায়তা কামনা করেন। জিয়া কর্ণেল পদে উন্নীত হন ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২; ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে একই বছরের ৬ জুন এবং মেজর জেনারেল পদে ১১ জুন ১৯৭৩। একই দিনে তাকে সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান নিযুক্ত করা হয়। ২৪ আগস্ট ১৯৭৫ তিনি সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন।
আর্মিতে অফিসারদের জ্যেষ্ঠতা নির্ণয় করা হয় তাদের সামরিক প্রশিক্ষণের সার্বিক ফলাফলের ভিত্তিতে। একই দিনে জিয়াউর রহমান ও শফিউল্লাহ কমিশন পেলেও প্রশিক্ষণের ফলাফলের ভিত্তিতে জিয়াকে জ্যেষ্ঠতা প্রদান করা হয়। জেনারেল জিয়া জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তাকে আর্মিতে রেখে জেনারেল শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করায় নৈতিক দিক দিয়ে সেনাবাহিনী পরিচালনায় স্বভাবতই তার দুর্বলতা থাকার কথা। স্বাভাবিক নিয়মে জিয়াকেই সেনাপ্রধান নিয়োগ করা উচিৎ ছিল। কিন্তু এই পদে নিযুক্তির ক্ষেত্রে সিনিয়রিটি সর্বদা চূড়ান্ত বিষয় নয়; বরং এটা একটা রাজনৈতিক স্বিদ্ধান্ত। জিয়াকে সেনাপ্রধান না বানানোর আরো কারণ ছিল। মেজর জেনারেল আইনুদ্দিন বলেন, ‘তাকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করা হয় নি, কারণ স্বাধীনতা ঘোষণার অনন্য কৃতীত্ব ছিল তার। তার ওপর শেখ মুজিবের বোনের ছেলে এবং আওয়ামি লীগের তাত্ত্বিক হিসেবে পরিচিত শেখ মণি চেয়েছিলেন, সেনাপ্রধানের পদে শফিউল্লাহকে বসানো হোক।’ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ মনে করেন, ‘শফিউল্লাহ ছিলেন জিয়ার তুলনায় বশংবদ। অপর কারণটি হতে পারে শেখ মুজিব জিয়াকে একজন প্রতিদ্বন্ধী হিসেবে দেখেছিলেন। তার মধ্যে গরহাজির নেতৃত্বের মানসিকতা কাজ করত।’ সেনাপ্রধানের পদ থেকে জিয়াকে বঞ্চিত করার আরো অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে। লেফট্যানেন্ট কর্ণেল এম আবদুল লতিফ খান বলেন, ভারতীয়রা চেয়েছিল শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করা হোক। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে জিয়ার ভূমিকার জন্য তারা তাকে পছন্দ করত না।
ক্ষমতার কেন্দ্রে জিয়াঃ সাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ঢাকা ব্রিগেডের সহায়তায় ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান ঘটালে জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয় এবং তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লব তাকে সেনাপ্রধানের পদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। অন্যদিকে খালেদ মোশাররফ ও তার দুইজন সহকর্মী কর্ণেল হুদা ও কর্ণেল হায়দার ৭ নভেম্বর সূর্য উঠার আগে সেনাদের হাতে নিহত হন। খালেদ মোশাররফের স্বল্পস্থায়ী ক্ষমতা দখলের ফলে ক্রমবর্ধমান বিভ্রান্তির মধ্যে রাষ্ট্রপ্রধানের পদে পরিবর্তন ঘটে। ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ খন্দকার মোশাররফকে ক্ষমতা ছাড়তে হয় এবং সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৭ নভেম্বর তিন বাহিনীর প্রধানগণ উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। বিচারপতি সায়েম ২৯ নভেম্বর ১৯৭৬ তৃতীয় সামরিক আইন ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ছেড়ে দিলে জিয়া সেই পদে নিযুক্ত হন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ২২ এপ্রিল জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে জিয়া ঘোষণা করেন, রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার প্রতি জিয়ার আস্থা আছে কি না তা যাচাই করতে ৩০ মে ১৯৭৭ গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। তাছাড়া এক ঘোষণায় বলা হয়, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধানের দায়িত্বও পালন করে যাবেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ জিয়াকে অস্থায়ী লেফট্যানেন্ট জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়, কিন্তু ৯ এপ্রিল আদেশটি বাতিল করতে হয়। ৯ এপ্রিলের আদেশে বলা হয়, জিয়াকে অস্থায়ী লেফট্যানেন্ট জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়েছিল ১৯৭৮ সালের ২৮ এপ্রিল এবং তিনি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন পরদিন ২৯ এপ্রিল।

জীবনযাপনঃ মৃত্যুর পর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জিয়ার ব্যক্তিগত যেসব জিনিসপত্র পাওয়া যায় সে সম্পর্কে একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন প্রকাশ পায়ঃ ‘জিয়ার ব্যক্তিগত মালামালের মধ্যে নিম্নলিখিত জিনিসগুলি পাওয়া যায়ঃ একটি পুরাতন চামড়ার স্যুটকেস। তাহা এত পুরাতন যে, উহার তালাও সঠিক কাজ করে না। একটি পুরাতন অতি সাধারণ টু-ইন-ওয়ান, তালাবদ্ধ একটি পুরাতন ইকোলাক জাতীয় ব্রীফকেস, গায়ের আধ ছেঁড়া গেঞ্জি, ২/৩ টি সাফারি শার্ট, একটি প্যান্ট, একটি ফাউন্টেন পেন, একটি সানগ্লাস। মৃতের মাথার কাছে পড়িয়াছিল কয়েকটি ক্যাসেট, তাহার বিছানার পাশেই পড়িয়াছিল জায়নামাজ ও সাদা গোল টুপি।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ জুন ১৯৮১।)
জিয়ার মন্ত্রীসভার সদস্য একেএম মাইদুল ইসলাম মুকুল লিখেছেন, ‘একদিন প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাথে হেলিকপ্টারে উঠলাম। তখন সময় সকাল সাড়ে ন’টা। প্রেসিডেন্ট সাহেবের হাতের ঘড়িতে দেখি সকাল সাড়ে সাতটা। তখন আমি বললাম, স্যার আপনার ঘড়িটা বোধহয় ঠিক না। তিনি হেসে বললেন যে, আমার একটা ভাল ঘড়ি ছিল। আর্মিতে থাকার সময় কুমিল্লার এক মিটিংয়ে হারিয়ে ফেলেছি। তারপর ঘড়িটা খুলে তিনি এডিসি সাহেবকে দিলেন ঠিক করিয়ে আনার জন্য। পরে এডিসি সাহেব আমাকে বললেন, স্যার এই সাড়ে চারশত টাকার ঘড়ি কতদিন যাবে বলেন তো? ঘড়ি মেরামতের দোকানিরা বললেন, এটার ভিতরের সবকিছু পুরোনো হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এর পার্টগুলো নতুন লাগিয়ে দেই। আমি হেসে বললাম যে, এটা যদি প্রেসিডেন্ট সাহেব জানেন, তাহলে একেবারে ফায়ারিং স্কোয়াডে দিবেন। যেমনটি আছে ঠিক তেমনটিই ঠিক করে আনেন।’
ঢাকায় বিদেশি অতিথিদের আগমনের পর কিংবা বিদেশ ভ্রমণকালে সেই অতিথি বা দেশের কাছ থেকে তিনি যেসব উপহারসামগ্রী পেতেন তার সবই জমা দিতেন বঙ্গভবনের রাষ্ট্রীয় তোষখানায়। একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ইরানের সাবেক সম্রাজ্ঞী ফারাহ দীবা বেগম খালেদা জিয়াকে ব্যক্তিগত উপহার হিসেবে ফিরোজা পাথর বসানো একটি আংটি দিয়েছিলেন। সেই আংটিও জমা হয়েছে তোষখানায়। প্রত্যেকটির ইনভেন্টরি জমা রয়েছে বঙ্গভবনে। প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর পর পত্রিকায় এসব সামগ্রীর তালিকা বেরিয়েছে।’
তার অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে নোবেলজয়ী অধ্যপক ড. ইউনুসের ভাই পদার্থবিজ্ঞানি ড. মুহাম্মদ ইব্রাহীমের স্মৃতীচারণ এখানে উল্লেখযোগ্যঃ এটি স্বাধীনতার প্রথম কয়েক মাসের মধ্যে অর্থাৎ বাহাত্তর সালের শুরুর দিকের ঘটনা। আকবর ভাইয়ের কাছ থেকে চিঠি পেলাম আমাকে দু’শ পাউন্ড ধার দিতে হবে কানাডাগামী কর্ণেল জিয়াউর রহমানকে। ……তিনি এখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে কানাডায় একটি কমনওয়েলথ সামরিক সম্মেলনে যোগদানের পথে লন্ডনে দু’একদিনের যাত্রাবিরতি করেছেন। সঙ্গে এমন কোন বাড়তি টাকা নেই যে কিছু ব্যক্তিগত কেনাকাটা করতে পারেন, তাই দু’শ পাউন্ডের মত সামান্য টাকাও তাকে পথে অপরিচিতের কাছ থেকে ধার করতে হচ্ছে। দেশের কিংবদন্তীর মত বীর এবং বরেণ্য একজন উচ্চ সামরিক কর্মকর্তার সাধারণ মানুষের মত এমন বিনীত জীবন, আমাকে দারুণ মুগ্ধ করলো।
বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আলেকজান্ডার স্টোরার সৈয়দ কামালউদ্দিনকে বলেছিলেনঃ তোমাদের প্রেসিডেন্টকে দেখো। তাকে কোনভাবেই ঘুষ দেওয়া যায় না। তিনি কঠিন টাস্কমাস্টার যা দূর্নীতিকে নিরুৎসাহিত করে। জিয়ার শাহাদাতবরণের পর নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখে, ‘জিয়া ছিলেন একজন মৃদুভাষী সামরিক ব্যক্তি, কঠোর পরিশ্রমি এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে দূর্নীতির ঊর্ধে। আর নতুন জাতিকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে প্রয়োজনীয় কঠিইন সিদ্ধ্বান্ত গ্রহণে তিনি ছিলেন পারঙ্গম।’
জিয়াই একমাত্র জাতীয় নেতা যিনি ব্যক্তিগত সম্পদের তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করেছিলেন। বাংলাদেশের খুব কমসংখ্যক রাজনীতিবিদই এমন প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত তা করেন নি।

কর্মবীর জিয়াঃ জিয়া প্রাসাদ রাজনীতিক ছিলেন না এবং মন্ত্রীসভার বেশ কিছু বৈঠক করেন ঢাকা থেকে দূরে, দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। এইরকম প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল সিলেটে ১২ অক্টোবর ১৯৭৯। সেনাবাহিনীতে চাকরির অভিজ্ঞতার সুবাদে তিনি দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে ভ্রমণে অভ্যস্ত ছিলেন। প্রায়ই তিনি গ্রামবাংলার এবড়োথেবড়ো পথ অনায়াসে পাড়ি দিয়েছেন। জিয়া এ ধরণের সফরে যেতেন উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতি পরিদর্শন করতে এবং জনগণের মন বুঝতে। জিয়ার এই ‘জানার জন্য হাঁটা’ অনুশীলনের শুরু ২৮ জানুয়ারি ১৯৭৭। সেদিন তিনি সিলেটের হাওড় অঞ্চলের শুকনো এলাকার ২২ মেইল পথ পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেন। এই রকম শেষ পদযাত্রাটি ২১ এপ্রিল ১৯৮০ বগুড়া সার্কিটহাউজ থেকে শুরু করে একটানা সাত মেইল পথ অতিক্রম করে। রাজশাহী বিভাগের সকল সংসদ সদস্য সেই কাফেলায় তাদের নেতার সাথে শামিল হয়েছিলেন। অন্য যেভাবে জিয়া নিজেকে জনগণের কাছে নিয়ে গিয়েছেন সেগুলোর মধ্যে ছিল বিশেষ ট্রেনে করে ভ্রমণ। এ ধরণের ট্রেনযাত্রা তিনি শুরু করেন ১৯৮০ সালের শেষ দিকে। ৫ অক্টোবর একটি বিশেষ ট্রেনযোগে ঢাকা থেকে দুই দিনের সফরে উত্তরাঞ্চলের শহর দিনাজপুর যাত্রা করেন জিয়া।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রথম দিকের দিনগুলোতে জিয়া সুশাসনের পন্থা সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ের পন্ডিত ও চিন্তাবিদদের মতামৎ জানতে তাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বঙ্গভবনে নিয়ে আসতেন।
মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে জিয়া নিয়তির দাবী পূরণ করেছেন। ইতিহাসে তার স্থান হবে একজন সাহসী ও সৎ মানুষ হিসেবে, দেশের প্রতি যিনি তাঁর দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করে গিয়েছেন।